বিভূতিভূষণের “আরণ্যক”-এর প্রকৃতি ও জীবনানন্দের “রূপসী বাংলা”
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সর্বদা ‘যৌবনোন্মত্ত তরুণ দেবতার’ মত খোঁজ করেছেন এক ভাবলোকের, যে ‘ভাবলোকের সন্ধান মেলে নদীতীরে নেমে আসা অপরাহ্ণের নির্জ্জনতায়, বনঝোপে ফোটা বনকলমী ফুলের উদাস শোভায়, আঁধার নিশীথে মাথার ওপরকার জ্বলজ্বলে নক্ষত্র ছিটানো ছায়াপথের বিরাট ইঙ্গিতে।’ আর এই ‘ভাবলোকের’ সাড়া তিনি পেয়েছেন নিজ হৃদয়ে, যার স্পন্দন তিনি পল্লীতে-শহরে হাটে-বাজারে, ঝোপে-ঝাড়ে, অরণ্য-পর্বতে-জঙ্গলে এবং স্থাবরে অনুভব করেছেন এবং তার সঙ্গে মনের গাঁটছড়ায় বাঁধা পড়েছেন। ফলে তার রচনাতে মানবজীবন ও প্রকৃতি একীভূত হয়ে অভিনব ব্যঞ্জনায় মূর্ত হয়েছে। সহজ সরল এক জীবন স্রোতের ক্ষণভঙ্গুর প্রভাব তার প্রতিটি রচনায় স্পষ্ট, আরণ্যক যার ব্যতিক্রম নয়।
রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা কথাসাহিত্যে বেশ ক’জন শক্তিমান লেখকের আবির্ভাব ঘটেছিল, তবে বাংলা উপন্যাসের মূল স্রোতধারার মধ্যে থেকেও মৌলিকতা এবং সরস উপস্থাপনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যিনি মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন, তিনি বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ঔপনিবেশিকতার যে ক্ষতিকর প্রভাব আমাদের স্বাধীন বাস্তব ব্যক্তি-বিকাশকে পক্ষাঘাতগ্রস্থ করেছে, বিভূতিভূষন তারই প্রতিবাদের প্রয়াস খুঁজেছেন তাঁর ‘আরণ্যক’ উপন্যাসটিতে। মানব চেতনা ও প্রকৃতির পারস্পারিক মিথস্ক্রিয়াই একমাত্র পারে ব্যক্তি বিকাশকে বিকশিত করতে। আর তাইতো আরণ্যকের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিটিকে সযত্নে একদিকে সরিয়ে রাখলে আমরা শুধু পাই অবারিত প্রকৃতির এক স্বপ্নময় দৃশ্যপট। এ সেই স্বপ্নময় দৃশ্যপট, যার দেখা পেয়েছেন জীবনানন্দ দাশের কবিমানসও। যে প্রকৃতির মাঝে জীবনানন্দ কাটাতে চেয়েছেন তাঁর জীবনসায়াহ্নের প্রতিটি ক্ষন-
“কার্তিকের অপরাহ্ণে হিজলের পাতা শাদা উঠানের গায়
ঝ’রে পড়ে, পুকুরের ক্লান্ত জল ছেড়ে দিয়ে চলে যায় হাঁস,
আমি এ ঘাসের বুকে শুয়ে থাকি—শালিখ নিয়েছে নিঙড়ায়ে
নরম হলুদ পায়ে এই ঘাস; এ সবুজ ঘাসের ভিতরে
সোঁদা ধুলো শুয়ে আছে—কাঁচের মতন পাখা এ ঘাসের গায়ে, নান্দাইল ইউনিয়নের বুকে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস